পথের পাঁচালীর পূর্বকথা - Pather Panchalir Purbakotha
by চিদানন্দ দাশগুপ্ত | Chidananda Dasgupta
সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রকাশকঃ নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র। মার্চ, ১৯৯২
আমার সিনেমা দেখার হাতেখড়ি সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে। পিতৃদেব ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক। সিনেমা দেখাকে পাপজ্ঞান করতেন। তখনকার অনেক ব্রাহ্মদের মতই ছবিতে যা দেখতে পাওয়া যায় তাতে তাঁর ততটা আপত্তি ছিল না, যতটা ছিল পর্দার অন্তরালের প্রতি। যারা বাস্তবে স্বামী-স্ত্রী নয় তারা স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করবে এটা তাদের কাছে পাপের আকর বলে বোধ হত, হোক না তারা পুণ্যবান রাজা হরিশ্চন্দ্র ও সতী তারামতী। ফলে বাল্যকালে শিলং ও কৈশোরে হাজারীবাগের মত ছোট শহরে পালিয়ে গিয়ে ছবি দেখারও সুবিধা ছিল না। বিবাহের পর যখন হাজারীবাগে সেণ্ট কলম্বাস কলেজে পড়াই তখন স্বামী-স্ত্রী মিলে একবার শাহেনশাহ বাবর দেখতে গিয়েছিলাম, সেও পালিয়ে। পরে জানতে পেরে পিতৃদেব এত দুঃখিত হয়েছিলেন যে হাজারীবাগে থাকাকালীন আর সিনেমা দেখা হয়ে ওঠেনি।
এরও অনেক বছর আগে হাজারীবাগে কলেজে পড়াকালীন ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের সংলগ্ন একটি ঘরে আমি দুটি ছোট আলমারী নিয়ে এবং নানা জায়গা থেকে বই জোগাড় করে একটি লাইব্রেরি করেছিলাম, তার নাম ছিল হাজারীবাগ পাবলিক লাইব্রেরি। সেখানে আমার ক্লাসের সহপাঠীরা এবং পাড়ার ছেলেরা বই পড়তে আসত। কিন্তু একটু গালভরা নাম না হলে কী মন ওঠে? যাই হোক সেখানে একদিন একজন বেজায় লম্বা ছেলে এসে হাজির, তার নাম মানিক, (সত্যজিৎ রায় নামটা অনেক পরে জেনেছিলাম), নিনিদি অর্থাৎ নলিনী দাস (তখন চক্রবর্তী)-এর সঙ্গে। নিনিদির বাবা হাজারীবাগে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, সেইসূত্রে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে জানাশোনা ছিল। তাছাড়া আমার মা মানিকের মা প্রভামাসীকে জানতেন এবং আমার পিতৃদেবও এফ. এ. (ফার্স্ট আর্টস-অর্থাৎ আই এর আগেকার নাম) ক্লাসে সুকুমার রায়ের সঙ্গে পড়েছিলেন। মনে আছে মন্দিরে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন প্রভামাসী, অর্গ্যান বাজিয়ে। যাই হোক সেই লাইব্রেরিতে মানিকের সঙ্গে আধঘণ্টার প্রথম পরিচয়। বইপত্র নিয়ে কিছু কথা হয়েছিল কিন্তু কি হয়েছিল মনে নেই। তার আয়তনটাই স্মৃতিতে গাথা রয়ে গেল, তাই বহুকাল পরে যখন কলকাতায় দেখি তখন চিনতে অসুবিধা হয়নি।
তখন আমি কাজ করি অধ্যাপক প্রশান্ত মহলানবীশের কাছে। তাঁর চিঠিপত্র মুসাবিদা করে দিতাম আর ‘সংখ্যা' নামে তাঁর পত্রিকার সম্পাদনায় সাহায্য করতাম। এই সময় মানিকের সঙ্গে আবার দেখা, ঐ নিনিদিব মারফত। আমি থাকতাম শ্বশুরালয়ে, প্লেসে সেখান থেকে তিনকোনা পার্কের দক্ষিনে নিনিদির বাড়ী খুব কাছে ছিল আর মানিক ও প্রভামাসি থাকতেন পাশের বাড়ি অর্থাৎ মানিকের মামাবাড়িতে।এটা উনিশশো ছেচল্লিশ সালের কথা। মানিকের তখনই সিনেমার প্রবল উৎসাহ।একদিন সকালে গেছি ,বলে না , না , এখন নয় , পলেট গডার্ড এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। মানিকের একটা সমস্যা ছিল, তার উৎসাহে যোগ দেওয়ার বিশেষ কেউ ছিল না আমাকে পেয়ে খানিকটা সেই সমস্যা মিটলো শুরু হলো আমার চলচ্চিত্র শিক্ষা।
তখন আমি 'পরিচয়'-এ সাহিত্য বিষয়ে নিয়মিত লিখি, পরিচয়ের আড্ডায় যাই, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা। সেই সূত্রে পূর্বাশায় আনাগোনা, সঞ্জয়বাবু তখন সবে আমার একটা পুত্তিকা ছেপেছেন তার নামটি সাংঘাতিক ভবিষ্যতের সাহিত্য।' ২০।২৫ পাতার চটি বই। ইতিমধ্যে আমি চাকরি বদলের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। সকালে টিউশনি, দিনে “প্রোফেসর" (মহালনবীশ তখন ঐ নামেই আমাদের কাছে পরিচিত)-এর সাগরেদি, সন্ধ্যায় সিটি কলেজে ইংরেজী পড়ানো, রাত এগারোটায় বাড়ি ফেরা আর সহ্য হচ্ছে না। একদিন মানিক বললে “তুমি আমাদের ওখানে চলে এসো না।” ডি. জে. কীমারে দিলীপ গুপ্ত ওরফে “ডি. কে"-র সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি ছ'মাস আমাকে দিয়ে সিগনেট্ প্রেসের নানা অনুবাদ, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির কাজ দিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে কীমারের চাকরিতে বহাল করলেন। মানিক সেখানে প্রধান শিল্পী, আমি সহকারী এগজিকিউটিভ। এর আগে থেকেই সত্যজিৎ আমাকে ছবি দেখানোর ভার নিয়েছে। কোন ভাল ছবির খবর পেলেই জানাত শুধু নয়, প্রায়ই আমার টিকিটটাও কিনে নিয়ে আসত।
আমি তখনো ডেভিড লীনের ব্রিফ এনকাউন্টার দেখিনি, মানিক বোধ হয় বার দশেক দেখেছে। একদিন দোলের ছুটিতে সকালে দেখানো হবে, ঠিক হল আমি একটি ট্যাক্সি নিয়ে মানিকের বাড়ি গিয়ে সেখান থেকে একসঙ্গে যাব। ট্যাক্সি জোগাড় হল, জানলা বন্ধ করে বেরোলাম কিন্তু তিনকোণা পার্ক পেরোতে পেরোতে বিপদ, সামনের জানলার কাঁচ ঘুরিয়ে কে যেন চোখেমুখে একগাদা রং ঢেলে দিল, মানিকদের বাড়ির সামনে তুলকালাম রং খেলা চলছে, ঢোকা অসম্ভব। আমাদের বাড়িতে রং খেলা ঘোর নিষিদ্ধ ছিল, য পলায়তি স জীবতি করে ট্যাক্সি ঘুরিয়ে সোজা নিউ এম্পায়ারে চলে গেলাম। দেখা হল 'ব্রিফ এনকাউন্টার"। পরে আরো দু'তিন বার দেখেছি, তবে মানিকের মত দশ পনেরো বার নয়।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মনোনিবেশের ক্ষমতার ফলে মানিকের প্রতিটি ছবির প্রতিটি দৃশ্য আর শট মনে থাকত। অনর্গল বলে যেতে পারত কীসের পর কী। ওর কাছ থেকে নিয়েই আমি রজার ম্যানভেলএর "ফিল্ম" বইটি পড়ে স্থিরনিশ্চিত হই যে তাহলে চলচ্চিত্র সত্যি একটি শিল্প। ফিল্ম সোসাইটি ব্যাপারটার সম্বন্ধেও তখন অবহিত হয়েছি। একদিন মানিক বললে, “একটা ফিল্ম সোসাইটি করা যাক, কী বলো?” আমি তৎক্ষণাৎ রাজী। দুজনে রাতারাতি যুগ্ম সম্পাদক হয়ে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি শুরু করে দিলাম। আমার বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয় পূর্ণেন্দু নারায়ণ ও তাঁর বন্ধু মনোজ মজুমদার আমাদের সঙ্গে যোগ দিল, এই চারজনেই আমরা ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির যাত্রা শুরু করি। প্রথম মিটিং হয় আমার শ্বশুরালয় ২৮ পন্ডিতিয়া প্রেসেরতিলের ছাতের ঘরেআর প্রথম ফিল্ম দেখানো হয় । তিনকোনা পার্কে মানিকের মামাবাড়ির বারান্দায় যতদূর মনে আছে ছবিটা ছিল 'দি গ্রেট ওয়ালজ' যাতে প্রধান নায়িকা ও অভিনেত্রী ছিলেন মিলিৎসা কোয়ার্স। মানিক তার অনেক আগে থেকেই পাশ্চাত্য সংগীতের মহাভক্ত। ওর এবং কবিচঞ্চল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেআমারও আমার স্ত্রীরসুপ্রিয়ার পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনার সুযোগ হত।
'দি গ্রেট ওয়ালজ’ ছবিটি আনা হয়েছিল বোধ হয় মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার-এর পরিবেশকের কাছ থেকে। ওই সময় মানিক ও আমরা প্রায়ই নানা হলিউড পরিবেশকের অফিসে আনাগোনা করতাম, ছবির খোঁজে।
একদিন মেট্রোর খাতায় ‘ডাল আল্ড লাইফ' নামটি দেখেই মানিক বললে, এটা কী জানো? এটা হচ্ছে জলিয় দ্যুভিভিয়ের কার্ণে দ্যু বাল বলে বিখ্যাত ছবির ইংরেজী নাম। ছবিটি ছিল ১৬ মিলিমিটারে। তখনো আমরা ৩৫ মি.মি.-তে দেখাবার ব্যবস্থা করতে পারিনি। টিনের কৌটোগুলি আমি তুলতে গেলাম. মানিক বলে উঠল-না, না, আমি নিয়ে যাচ্ছি। শুধু সেদিন নয়, ছবি নিতে গেলেই তা-ই হত, ওগুলো বগলদাবা করে মানিকের কী পরিতৃপ্তি, কারুর হাতে দেবে না। মেট্রোরই হাফিসজী অবশেষে সকালবেলা মেট্রোয় ৩৫ মি.মি. ছবি দেখানোর বন্দোবস্ত করে দেন। একটি মেক্সিকোর ছবি “মারিয়া কান্দেলারিয়া", পরিচালক এমিলিও ফার্নান্দেজ, ফোটোগ্রাফার গারিয়ে ফিগারোয়া ও প্রধান ভূমিকায় পেট্রো আরমান্দারিজ ও দলোরেম দেল রিও ছিলেন। এখন দেখলে কী মনে হবে জানি না, তখন মনে হয়েছিল একটা নতুন জগৎ খুলে গেল। স্মৃতির হিসাবে ভাবতে গেলে মনে হয় যেন মেক্সিকো-র 'পথের পাঁচালি। এখন হয়ত বেশি ভাবাধ মনে হতে পারে জানিনা। বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল। গণ্যমান্য শিল্পীসাহিত্যিক অনেকে এসেছিলেন। সকলেরই ছবিটি খুব ভাল পেয়েছিল, সুতরাং ভাবাপ্রতার ভয়টা হয়ত অমূলক। যাই হোক, হাফিী জনসমাগম দেখে অবাক। আমি বললাম, কী, এসব ছবিতে নাকি লোক হয় না বলে আপনারা দেখান না? চুপ করে রইলেন। আমাদের সঙ্গে তর্ক করতেন, যে ছবি চলে না সে আবার ভাল ছবি কী করে হয়। কিন্তু সাহায্য করতেন। লাইট হাউসের ম্যানেজার মার্শালও অকুণ্ঠ সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। নইলে তখনকার দিনে ফিল্ম সোসাইটি চালানো অসম্ভব ছিল। সত্যজিৎ এর ডিজাইন ও লেখা নিয়ে আমাদের প্রথম ‘বুলেটিন' বেরোয়, তারপরেই ইংরেজী ত্রৈমাসিক।
১৯৫২-র ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে দিনে তিনটি করে শো এবং রবিবারে সকালের শো নিয়ে বাইশটি ছবি দেখি। এর আগেই সত্যজিৎ ইংলণ্ডে ঘুরে এসেছে, শ'খানেক ছবি দেখে। তখন থেকেই তার ফিল্ম সোসাইটির ছুটোছুটিতে অনীহা। অন্য লোকে ফিল্ম হাতে নিতে গেলে আপত্তি নেই। 'পথের পাঁচালি'র চিত্রনাট্য লেখা চলছে কিংবা হয়ে গেছে। রবিবার ও ছুটির দিনে মানিক, সুরত মিত্র ও বংশী চন্দ্রগুপ্ত শুটিং করতে যায়। ১৯৪৮/৪১-এ ফিলিপ ক্রসল্যাও-এর উৎসাহে মানিক ও আমি গুটিকয়েক প্রবন্ধ লিখেছি, সিনেমা বিষয়ে। মানিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল হোয়াট্স রং উইদ্ ইণ্ডিয়ান ফিল্মস। তাছাড়া সে লিসে এণ্ডারসন-এর সিকোয়েন্স পত্রিকায় কলকাতায় রেনোয়া সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখেছে। রেনোয়ার সঙ্গে সেই সময়ে (১৯৪৮-৪৯) সত্যজিতের ও সুব্রত, বংশীর যোগাযোগ ঐতিহাসিক। তাত্ত্বিক দিক থেকে আমিও তার ভাগীদার। ১৯৫২ সালে পুদভকিন ও চেরকাসভের আসা-ও বিরাট ঘটনা। সত্যজিৎ ছবি তৈরির দিকে ঝুঁকতে আমার, পূর্ণেন্দু ও মনোজের-ও উৎসাহে একটু ভাটা পড়ল। ১৯৫২ থেকে '৫৫ পর্যন্ত ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির দীপ নিভু নিভু। ১৯৫৫-৫৬ সালে মারী সীটন-এর আইজেনস্টাইন বক্তৃতামালার পর সেই দীপ আবার দপ্ করে জ্বলে উঠল। ততদিনে সত্যজিৎ জগদ্বিখ্যাত হতে শুরু করেছে। আর যুগ্ম সম্পাদক নেই বা পরিবেশকদের ঘরে ঘরে ঘোরে না। কিন্তু ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের নেতৃত্বে সে পুরোভাগে থেকে যায়। আজো এবিষয়ে তাঁর সাহায্য অব্যাহত।
Other articles in this category
- সোভিয়েত চলচ্চিত্র-পঞ্চাশ বছর | Soviet Chalachitra 50 Bochor- প্রবাদ পুরুষ - Prabad Purush
- সত্যজিৎ রায়ের আঁকাজোকা - Satyajit Rayer Anka Joka
- Reading History with Satyajit Ray
- পথের পাঁচালীর পূর্বকথা - Pather Panchalir Purbakotha
- প্রথম সম্বর্ধনা , প্রথম মানপত্র | First Felicitation, First Certificate
- Shining a light on Satyajit Ray
- সত্যজিৎ-চলচ্চিত্রে কালচেতনা | Significance of Time in Ray's Film
- ডক্টর সত্যজিৎ রায় | Doctor Satyajit Ray
- চিন্তা ও সৃষ্টি | Idea and Creativity
- Manikda and the little songs of his cherished road
- Eclipse Series 40: Late Ray
- Feluda is one of Satyajit Ray’s greatest creations but is he too brilliant for the movies
- Returning to Life: The Apu Trilogy in Buffalo
- Revisiting Ray’s Films In The Current Socio-Economic Context Of India
- The Apu Trilogy: Every Common Sight