প্রবাদ পুরুষ - Prabad Purush
by মৃণাল সেন | Mrinal Sen
সত্যজিৎ রায় : সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রকাশকঃ নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র। মার্চ, ১৯৯২
যাঁকে নিয়ে বা যাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে লিখতে বসলেই একসময়ে কলম চলত তরতরিয়ে, মন চলত আরো দ্রুত, তাঁকে নিয়ে এখন যদি কোন লিখিয়েকে মৌলিক কিছু লিখতে বলা হয় তো কি লিখবেন সেই লিখিয়ে? নতুন কিছু কি লেখা যায়? সম্ভব কি? অনেক কিছুই তো লেখা হয়ে গেছে, সবই হয়েছে একনাগাড়ে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর-দেশে, বিদেশে, সর্বত্র। শুরু হয়েছে ১৯৫৫ সালের সেই দিনগুলো থেকে, যখন এদেশেরই একজন, আমাদের কলকাতারই একজন, এক আচমকা বিস্ময় ঘটিয়ে ছিলেন এদেশেরই ছবির পর্দায়। অনন্যসাধারণ, অনির্বচনীয়। কে তিনি? কারা তাঁর সঙ্গী-সাথী তাঁর ভাবনা-চিন্তার, সেদিনের তাঁর দৌড়োদৌড়ি ছোটাছুটির সর্বক্ষণের সহচর? ছবির জগতে তাঁর বা তাঁদের কি কোন পরিচিতি ছিল তখন? বিন্দুমাত্র না। কিন্তু হঠাৎ; হঠাৎ-ই, সেদিন এক বিশাল ঘটনা ঘটে গেল এদেশে। জীবনের অপূর্ব মাধুর্য ফুটে উঠল ছবির পর্দায়। যেন এক অচলায়তনের সিংহদ্বার গুঁড়িয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল নামগোত্রহীন গুটিকয়েক মানুষ, সাবেকি অথবা আক্ষরিক অর্থে কারিগরি অভিজ্ঞতা যাদের কারুরই তেমন ছিল না, প্রায় শূন্যের কোঠায়, অথচ যাঁরা ওই ভাবে জবরদস্তি, সরাসরি ঢুকে পড়েই জাঁকিয়ে বসলেন রুচিবোধসম্পন্ন দর্শকের মনের মণিকোঠায়।
গভীর আবেগে আপ্লুত দর্শকের সামনে তখন ছড়িয়ে পড়েছে ছবির ও শব্দের অপূর্ব সমারোহ, জীবনের কাব্য, জীবনের মহিমা, সত্তার উজ্জ্বল স্নিগ্ধতা। লাবণ্য ছড়াল ছবি ও শব্দের নিবিড় গঠন-কৌশলে, ঘটনার সুঠাম পারম্পর্যে, কাহিনীর নিপুণ বিন্যাসে, চরিত্রের নিখুঁত বিশ্লেষণে। লাবণ্য-প্রকৃতির অকৃপণ বিস্তারে, বৃষ্টির অঝোর ধারায় বৃষ্টির জলে দুর্গার চুল ভিজিয়ে নেওয়ায়, শান্ত পুকুরে ছোট ছোট পোকার স্বচ্ছন্দ অস্থিরতায়, কাশবনের ছন্দোবদ্ধ আন্দোলনে। তারই সঙ্গে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের আশ্চর্য সুন্দর মাখামাখিতে-বিস্তীর্ণ কাশবন পেরিয়ে অপু দুর্গার অবাক দৃষ্টি যখন আটকে যায় আকাশ যেখানে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে, আকাশটা কালো হয়ে যাচ্ছে রেল-ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়ায়, আর রেলগাড়িটা ছুটছে তারই স্বাভাবিক গতিতে। এবং এমনি সব আরো কত কিছু। তারই মধ্যে ঘরোয়া জীবনের নিটোল প্রতিচ্ছবি, সুখ দুঃখের আলো আঁধারি, পরিবেশের চাপে কেউ বা কখনো সংকীর্ণতায় মলিন কখনো বা ঔদার্যে ভাস্বর। এবং সব কিছু ছাপিয়ে সদ্য মেয়ে-হারা সর্বজায়ার বুকফাটা বোবা আর্তনাদ। আর গোটা ছবি জুড়ে গ্রাম বাঙলার দারিদ্র্যের হাহাকার।
অনাস্বাদিত, অভূতপূর্ব।
এইভাবেই সেদিন, ১৯৫৫ সালে, শিল্পের জগতে এক মহাবিপ্লব ঘটে গেল এদেশে, সঙ্গে সঙ্গে সশ্রদ্ধ সাড়া দিল গোটা পৃথিবী।
এবং এইভাবেই সেদিন দেশজ সত্যজিৎ রায় আন্তর্জাতিক হয়ে উঠলেন রাতারাতি। এবং চলেই চললেন দীর্ঘদিন, এগিয়ে চললেন। আর সেই শুরু থেকেই শুরু হল লেখালেখি-অজস্র, অসংখ্য-এদেশে, ওদেশে, সারা পৃথিবীতে। আর যা ঘটে থাকে মহৎ শিল্পীর দীর্ঘকালীন কর্মকাণ্ডের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে অকুণ্ঠ প্রশস্তি এবং তারই পাশাপাশি কখনো সখনো কিছু প্রশ্ন, কিছু বা সংশয়, কিছু বিতর্ক-যা চ্যাপলিনও এড়াতে পারেন নি, তাও ঘটল সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে। তারই মধ্যে সোজা দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মত করেই চলতে থাকলেন, চলতে চলতে আবার হঠাৎ হঠাৎ-ই, কিছু দিনের জন্য থেমে পড়লেন, শারীরিক কারণেই থামতে হ’ল, আবার চললেন, বললেন, বুঝলেন কাজ, শুধু কাজই তাঁর শরীর ও মনকে তাজা রাখে, তাঁকে চালিয়ে নেয়।
আজ সত্যজিৎ রায়ের ৩৬ বছরের সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেকেই যখন অনেক কথা লিখে ফেলেছেন, যখন লেখার আর বাকি কিছু আছে বলে মনে হয় না, তখন চর্বিত চর্বণের ভয়ে কোন সংযোজন করতে ভরসা পাই না। তাঁর নতুন জন্মদিনে আমি তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই, ভাবি পুরনো দিনের নানা কথা, নানা লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত, যেসবের অনেক কিছুরই প্রত্যক্ষদর্শী আমি। আর মনে পড়ে, দেখেছি, জেনেছি বলেই বার বার মনে পড়ে, এই দীর্ঘদেহী প্রবাদপুরুষকে সেই দিন এবং পরবর্তী কালেও তাঁর সঙ্গে বহুদিন নিবিড় হয়ে থেকেছিলেন যে-দুই প্রধান সহচর, তাঁর কর্মকাণ্ডের সেই দুই অন্তরঙ্গ শিল্পী—বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও সুব্রত মিত্র— তাঁরা, আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি, আজও সত্যজিৎ রায়ের মানস জগতে জড়িয়ে আছেন গভীরভাবে। আমি বলি, আমি বলব, সত্যজিৎ রায়ের নতুন এবং বিশিষ্ট জন্মদিনটি সার্থকতম হয়ে উঠুক এই দুই প্রতিভার স্মৃতিচারণেও, যে-দুজন অজস্র কথার ভিড়ে আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছেন।
Other articles in this category
- সোভিয়েত চলচ্চিত্র-পঞ্চাশ বছর | Soviet Chalachitra 50 Bochor- প্রবাদ পুরুষ - Prabad Purush
- সত্যজিৎ রায়ের আঁকাজোকা - Satyajit Rayer Anka Joka
- Reading History with Satyajit Ray
- পথের পাঁচালীর পূর্বকথা - Pather Panchalir Purbakotha
- প্রথম সম্বর্ধনা , প্রথম মানপত্র | First Felicitation, First Certificate
- Shining a light on Satyajit Ray
- সত্যজিৎ-চলচ্চিত্রে কালচেতনা | Significance of Time in Ray's Film
- ডক্টর সত্যজিৎ রায় | Doctor Satyajit Ray
- চিন্তা ও সৃষ্টি | Idea and Creativity
- Manikda and the little songs of his cherished road
- Eclipse Series 40: Late Ray
- Feluda is one of Satyajit Ray’s greatest creations but is he too brilliant for the movies
- Returning to Life: The Apu Trilogy in Buffalo
- Revisiting Ray’s Films In The Current Socio-Economic Context Of India
- The Apu Trilogy: Every Common Sight