সত্যজিৎ রায়ের আঁকাজোকা - Satyajit Rayer Anka Joka
by পরিতোষ সেন | Poritosh Sen
সত্যজিৎ রায় - সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রকাশকঃ নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র। মার্চ, ১৯৯২
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে কলকাতার প্রকাশনার জগতে ছোটখাটো একটা বিপ্লবের গোড়াপত্তন হল। এ বিপ্লবের দুই নেতা-একদিকে দিলীপ গুপ্ত আরেক দিকে সত্যজিৎ রায়। দু’জনের মোলাকাত হয় তখনকার দিনের প্রসিদ্ধ ডি.জে. কীমার (বর্তমানে ক্লারিয়ন এডভার্টাইজিং লিমিটেড) বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী হিসেবে। সোনা আর সোহাগার মিশ্রন হলে যা হয় ঠিক তাই হল। দিলীপ গুপ্তর কর্তৃত্বে জন্ম হল প্রসিদ্ধ সিগনেট প্রেসের। আর তার সমস্ত প্রকাশনার নকসা আর সজ্জার দায়িত্বভার নিলেন সত্যজিৎ রায়। পর পর বেরুতে থাকল অত্যন্ত সুশ্রী সব বই। অর্থাৎ, যেমন তাদের ঝরঝরে ছাপা, পাতার সজ্জা, টাইপোগ্রাফি তেমনি তাদের ইলাস্ট্রেশন। সুকুমার রায়ের “পাগলা দাশু”, “হ য ব র ল", অচিন্ত্য সেনগুপ্তের “পরম পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ,” “শ্রীশ্রী সারদাময়ী”, জীবনানন্দ দাসের “রূপসী বাংলা”, জওহরলাল নেহেরুর “ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া” আরও কত কি! প্রকাশনার জগতে সে এক সাড়া জাগানো ব্যাপার। সিগনেট প্রেসের জন্মলাভের আগে একমাত্র বিশ্বভারতীর প্রকাশিত বইপত্রের চেহারাতেই নান্দনিক দিকের প্রতি খানিকটা মনোযোগ দেয়া হত। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় প্রকাশিত বইয়ে তেমনটি বিশেষ দেখা যেত না। তবে বিশ্বভারতীর প্রকাশনার একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠেছিল কিঞ্চিৎ, ইংরেজীতে যাকে বলে, 'Sombre', তবুও তারই মধ্যে কয়েকটি যেমন, মুগা দিয়ে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথের "স্ফুলিঙ্গ”, “মহুয়া" ইত্যাদি ছোট ছোট বই ছিল সুন্দর। তখনকার দিনের প্রকাশনার ক্ষেত্রে এগুলোইবা কম কিসের। আমার ধারণায় বিশ্বভারতীর এই Somberness-এর একটা কারণ হতে পারে যে তাদের ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য প্রকাশনার একচেটিয়া অধিকার এবং প্রতিযোগিতার অভাব। যাই হোক সিগনেট প্রেসের আবির্ভাবের দরুন প্রকাশনায় তার বাহ্যিক রূপের যে আমূল পরিবর্তন ঘটল তা যুগান্তকারী বললে হয়ত অত্যুক্তি হবে না। এখনো মনে পড়ে বইয়ের দোকানের রাস্তার মুখোমুখি শো-কেসে রাখা অনেক বইয়ের মধ্যে সিগনেটের বইগুলো তাদের নিজেদের নকসাগুণে কীরকম স্বাতন্ত্র্য লাভ করে ঠিকরে বেরিয়ে আসত, যে কোন ভাল বিদেশী প্রকাশনার সঙ্গে অনায়াসেই টেককা মারত। যদিও বিদেশী প্রকাশনা সংস্থার আর্থিক ক্ষমতা ছিল অনেক গুণে বেশি। এই আশ্চর্য সফলতার পেছনে শুধু দুটি (দিলীপ গুপ্ত এবং সত্যজিৎ রায়) নিতান্তই খুঁতখুঁতে মনই ছিলনা, ছিল দুটি প্রতিভার গভীর চেতনা যে, মুদ্রণ শিল্পকে এক নতুন নান্দনিক স্তরে তুলে ধরতে হবে। এটা ছিল অতি উচু দরে আদর্শগত চেতনা, যেখানে লাভ লোকসানের বিবেচনাটা ছিল গোণ। যদি লাভ লোকসানই বড় কথা হত তাহলে সিগনেট প্রেস আজ শুধু টিকেই থাকত না, ফুলে ফেঁপে এক বিরাট প্রকাশনাকেন্দ্র হয়ে মহত্বলাভ করত। তাঁদের কাছে এটা ছিল একটা স্বপ্ন যাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে তাঁরা ছিলেন বদ্ধপরিকর।
গ্র্যাফিক ডিজাইনার হিসেবে সত্যজিৎ প্রসিদ্ধি লাভ করার আগেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি সবেমাত্র শান্তিনিকেতনের কলাভবনে কিছুদিন নন্দলাল এবং বিশেষ করে বিনোদবিহারীর সান্নিধ্যে লাভবান হয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। এই শান্তিনিকেতন পর্ব, সংক্ষিপ্ত হলেও, (তিনি কলাভবনের পুরো কোর্স শেষ করার সুযোগ পাননি, আর্থিক কারণে ডি.জে.কীমার-এ চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন) তাঁর শিল্প-মানসিকতার বিকাশের পক্ষে এক মহত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আমি মনে করি। শান্তিনিকেতুনের দিগন্ত আকাশ, বিভিন্ন ঋতুতে গাছপালায় প্রকৃতির বিচিত্র বিকাশ, সেখানকার লাল রুক্ষ্ম মাটি, আদিবাসীদের সহজ, সরল, স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ, কীটপতঙ্গ –এক কথায় সৃষ্টির রহস্যের যে হদিশ তিনি সেখানে অনুভব করলেন, বিশেষ করে কলাভবনের অভিজ্ঞ, কৃতী শিক্ষকদের অধীনে এবং সর্বোপরি, রবীন্দ্রনাথের স্নেহভাজন হয়ে, তা তাঁর চিরকালের পাথেয় হয়ে রইল। চলতি কথায় বলা যায় সেইখানেই তাঁর চোখ ফুটেছিল। একথাটি, নিছক তথ্য হলেও, গ্র্যাফিক আর্টিস্ট এবং ফিল্ম মেকার হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভার বিকাশের পক্ষে, আমাদের মনে রাখা অত্যন্ত জরুরী যে, দৃশ্যমান জগৎকে এক নতুন চোখে দেখার সুযোগ এবং শিক্ষা তিনি সেখানেই পেয়েছিলেন। (এ প্রসঙ্গে একদিন তিনি আমায় বলেছিলেন যে, 'পথের পাঁচালিতে দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার আগে ছিপধারী টেকো লোকটার দৃশ্যটির অবতারণায়, পোকা-মাকড়দের জলের ওপর সহজে হেঁটে যাবার দৃশ্যটি দেখাবার, কিংবা সেসব ভাবনার কথা আদৌ তাঁর মানসে উদয় হত না, যদি না কলাভবনের ছাত্র হিসাবে তিনি নন্দলাল, বিনোদবিহারী এবং সরাসরি না হলেও, রামকিংকরের সান্নিধ্যে আসতেন। সত্যজিতের চোখ-ফোটার আরেকটি দিকে ছিল দৃশ্যমান জগতকে তাঁর আঁকায় কীভাবে প্রতিফলিত করতে হয়। একদিকে তিনি চোখে যেমন দেখছেন তেমনটি করে আঁকতে শিখলেন, অন্যদিকে শিখলেন এজগতকে অন্তর্মুখী এক দৃষ্টিতে দেখতে, যেদৃষ্টি যুগ যুগ ধরে ছিল গোটা প্রাচ্যের ধ্রুপদী এবং লোক-শিল্পকলার চাবিকাঠি হয়ে। ডি.জে.কীমার সংস্থায় আর্ট ডিরেক্টর কাম-ভিস্যুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করার সময় যেসব বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত কাজ করেছেন তাতে আমরা এই দুরকমের আঁকাজোকাই দেখতে পাই। বলা বাহুল্য ফিল্মর ড্রইংএ তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, সে কথাটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার অনেক শিল্পীদের বেলায়ই বলা চলে না। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তিনি সেখানকার শিল্প এবং বইএর সংগ্রহশালা থেকে আমাদের দেশের যাবতীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তাই তাঁর কাজে কখনো লোকশিল্পের, আবার কখনো ধ্রুপদী-শিল্পের মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা দেখতে পাই, এবং যেহেতু তিনি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য,এ-উভয় শিল্পের ধারাবাহিকতা সম্বন্ধে বেশ জ্ঞাত ছিলেন, তাতে করে তাঁর শিল্প চেতনায় এসেছে এক উদারতা যা তাঁর ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রকার জীবনে বিশেষ প্রসারতা লাভ করেছে। এখানে একটি কথা পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যে-সময় সত্যজিৎ বিজ্ঞাপনী শিল্পে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন সে-সময় আরও দুজন বাঙালি বিজ্ঞাপনী-শিল্পী এ ধারার বীজ রোপনের জন্যে জমি তৈরি করেছিলেন। বাঙালি বিজ্ঞাপনী-শিল্পের ইতিহাসে অন্নদা মুন্সী এবং ও, সি, গাঙ্গুলীর নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। চল্লিশ-পঞ্চাশ এমনকি ষাটের দশকের প্রথমার্ধেও তাঁদের আঁকা ক্যালেণ্ডার, সিনেমার পোস্টার, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে একদিকে যেমন বলিষ্ঠ নক্সা দেখতে পাই তেমনি পাই এক দেশী সুগন্ধ যা ইতিপূর্বে এ ধরনের শিল্পে দেখা যায় নি। (বলা বাহুল্য, বিজ্ঞাপনী-শিল্পের আমদানি হয়েছিল বিদেশ থেকে, তাই একসময় তার প্রভাবও ছিল প্রচণ্ড)। সত্যজিৎ এ-দুই পুরোধা শিল্পীর সহকর্মী হিসেবে এই ধারাকে নানাভাবে আরও সমৃদ্ধ করে তুললেন। তার একটি মহত্বপূর্ণ দিক হল বিজ্ঞাপনী-শিল্প, তা পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপনই হোক, কিংবা বইয়ের মলাট হোক কিংবা পোস্টারই হোক-এসব জিনিসের চিত্রগত দিকের সঙ্গে বাংলা কিংবা ইংরেজী হরফের মানানসই ব্যবহার, ইংরেজীতে যাকে বলা হয় 'টাইপোগ্রাফি'। এই হরফের উপযুক্ত এবং বিচক্ষণ ব্যবহারে শিল্পী, ছবির ব্যবহার ছাড়াও, একটি বিশেষ আইডিয়াকে বলিষ্ঠ কিংবা সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সত্যজিতের কাছে এক মুস্কিল দেখা দিল। ইংরেজীতে কয়েক হাজার ছাপার অক্ষর পাওয়া যায়। সে তুলনায় বাংলা ছাপার হরফের সংখ্যা মাত্র কয়েকটি। এ অবস্থায় তিনি তুলি, কলম, এমনকি তুলির ডাটের উল্টোদিক দিয়ে লিখে বাংলা হরফের এ-দৈন্যের মোকাবিলা করলেন। ইংরেজীতে 'ক্যালিগ্রাফি' বলে একটা কথা আছে যা সুন্দর হস্তাক্ষর সংক্রান্ত এবং যার উৎকর্ষ তুলি, কলম কিংবা এ ধরনের যে-কোন জিনিসের দ্বারা হাসিল করা যায়। সত্যজিৎ রায়ের ক্যালিগ্রাফী শিল্পের প্রতি আগ্রহের উদ্রেক করেছিলেন তাঁর গুরু বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, যিনি সেটা আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর জাপান ভ্রমণ কালে। অল্প কয়েকটা তুলির (কিংবা কলমের) টানে যে কি কাণ্ড করা যায় তা যাঁরা বিনোদবাবুর ছবি, স্কেচ কিংবা তাঁর কৃত মলাট (বিশ্বভারতী পত্রিকার মলাট দ্রষ্টব্য) দেখেছেন তারা আমার দেখেছেন তাঁরা আমার বক্তব্যের মর্মকথাটি বুঝতে পারবেন। এই ক্যালিগ্রাফীর মাধ্যমে সত্যজিৎ সৃষ্টি করলেন নানা ধরনের হরফ, যা, বিশেষ করে, বাংলা হরফের ক্ষেত্রে, আনল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এবং যার দরুন বাংলা বিজ্ঞাপন, বইএর এবং রেকর্ড কভারে এমনকি নিমন্ত্রণ পত্রেও এল এক নতুন চেহারা যা আজও অব্যাহত আছে। এখনো চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা কাজে, এবং সাহিত্য রচনায় ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি সুযোগ পেলেই আমাদের নতুন নতুন ক্যালিগ্রাফিক নক্সা উপহার দিয়ে থাকেন। তাঁর চলচ্চিত্রের পোস্টার কিংবা ব্যানারে, বইয়ের মলাটে এবং বার্ষিক 'এক্ষণ' পত্রিকার মলাটে প্রতিবছর আমরা এক অসাধারণ নক্সাবিদ এবং হরফবিদের নতুন পরিচয় পাই। একটা কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, শান্তিনিকেতনে তাঁর শিল্পশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রশিক্ষার প্রারম্ভিক পঠন-পাঠন। সেখানকার লাইব্রেরিতে রক্ষিত ফিল্ম সংক্রান্ত যা কিছু বই তিনি তখন পেয়েছিলেন তা পাঠ করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন। কাজেই একদিকে নক্সা এবং হরফবিসের বীজ এবং অন্যদিকে চলচ্চিত্রকারের বীজ এ-দুইই সেখানে একই সঙ্গে রোপিত হয়েছিল, শুধু এ দুটির অঙ্কুরকালের মধ্যে কিঞ্চিৎ ফারাক। 'পথের পাঁচালি' থেকে সত্যজিৎ রায় নক্সাবিদ অর্থাৎ গ্র্যাফিক ডিজাইনার হিসেবে এক নতুন আলোয় প্রকাশিত হলেন। কলকাতার বিশেষ বিশেষ রাস্তার সংযোগস্থলে যারা তাঁর কৃত বিশাল বিশাল ব্যানার এবং পোস্টার ডিজাইন দেখেছেন তাঁদের মনে আজও সেগুলো উজ্জ্বল হয়ে আছে। তারপর থেকেই তাঁর নির্মিত একের পর এক ছায়াছবির মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আমরা পেয়েছি নতুন থেকে নতুনতর সব ডিজাইন এবং হরফের খেলা। এটি এমন একটি প্রবাহিণী যার স্রোতে ঘটে নিত্য নতুন জলের মিশ্রণ এবং যে-স্রোতে আজও কোন ভাটা পড়েনি। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি তখন যেমন প্রখর ছিল আজও তেমনি আছে। হরফের প্রতি তাঁর অনুরাগ, হরফকে শুধু একটা চিহ্ন হিসেবে না দেখে একটা ইমেজ কিংবা মূর্তি হিসেবে দেখা, এ ঝোঁক তাঁর বহুকালের। এ দৃষ্টি যাদের থাকে তারাই হরফের আকারের সঙ্গে প্রকৃতির অন্য কিছুর সঙ্গে মিল দেখতে পান। যেমন ধরুন ইংরেজীর ছোট অক্ষরের ‘এ’র সঙ্গে একটি হাঁসের মিল অনেকেই দেখতে পাবেন। কিংবা বাংলার 'শ'-র সঙ্গে একটি ফলশোভিত বৃক্ষের মিলও কম নয়। এ ধরনের বহু উদাহরণ মারফৎ আমার এ বক্তব্যকে আরও জোরাল এবং স্পষ্ট করা যায়। এমন চেতনা যাঁদের থাকে তাঁরাই নতুন নতুন হরফ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। তবে ফ্রি ক্যালিগ্রাফি'র বেলায় যে অবাধ স্বাধীনতা থাকে, মুদ্রণ শিল্পের অর্থাৎ ছাপাখানার জন্যে তৈরি হরফে সে স্বাধীনতা অনেক কম। তা সত্ত্বেও, সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট তিনটি হরফ Ray Roman, Daphnis, Bizarre ইংরেজী হরফের ক্রমবর্ধমান সংগ্রহকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। নিতান্তই অনুতাপের বিষয় এই যে, বাংলার ছাপাখানার জন্যে এমন কোন চিহ্ন তিনি এখন পর্যন্ত রাখতে সমর্থ হননি। এটা তাঁর কোন প্রকার অক্ষমতার দরুন নয়, বাংলা মুদ্রণ শিল্পের আগ্রহের অভাবে এবং দূরদর্শিতার অভাবের দরুন। যদি তাকে দিয়ে এমন একটি কাজ করান যেত তা এপার এবং ওপার বাংলার মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে তাঁর আরও অনেক কীর্তির মত অবিস্মরণীয় হয়ে থাকত।
১৯৫৪ সালে দীর্ঘদিন প্যারিসবাসের পর দেশে ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই সত্যজিতের মুদিয়ালী রোডের বাসভবনে যাই। তিনি খুব উৎসাহ কিন্তু চাপা উত্তেজনা সহকারে তাঁর অনেকাংশ তোলা পথের পাঁচালি'র কথা জানালেন এবং তা দেখবার জন্যে আমন্ত্রণ জানালেন। বলা বাহুল্য, সেদিন যে সব ‘rushes' দেখে অভিভূত হয়েছিলাম, তার বেশ কিছু অংশ প্রচলিত 'পথের পাঁচালি' ছায়াছবির থেকে বাদ পড়েছে। একথা আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে যে, তাঁর সৃষ্ট অনেক ছায়াছবির যে-সব অংশ সম্পাদনার কাঠগোড়ায় বলি হয়েছে, স্রেফ নান্দনিক বিচারে উত্তীর্ণ সেসব অংশের ক্যাসেট তৈরি করলে কেমন হয়। হয়ত তাতে অনেক এমন রত্ন বেরিয়ে আসবে যা দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকবে না। যেমন ধরুন, পথের পাঁচালির ঝড়ের দৃশ্যের অবতারণা। প্রবল বায়ুতে হিন্দোলিত বাশ গাছের কিছু ‘rushes' দেখেছিলাম যা দেখে জাপানি মাস্টারদের আঁকা বাশ গাছের ছবির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এমন অনেক ‘rushes' তাঁর প্রথম দিকের ছবির থেকে বাদ পড়েছে। পরের দিকে শট-টেকিং-এ তিনি এমনই মিতব্যয়ী হতে শিখলেন যে, যা তোলা হয় তার থেকে বাদ যায় খুব কমই। 'পথের পাঁচালির কাজ শুরু করার আগে থেকেই সত্যজিৎ রায় তার ছবির শট-টেকিং অর্থাৎ ক্যামেরার ফ্লেমিং কী রকম হবে তা আগে থেকেই এঁকে নিতেন। অনেকের হয়ত জানা নেই, তিনি একসময় রবিশংকরের সেতারবাদ্য এবং তার সঙ্গে তবলার সঙ্গতের ওপর একটা অল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করার কথা ভেবেছিলেন এবং পর্দায় কি রকম দেখতে হবে তা মোটামুটি আঁচ করার জন্যে প্রস্তাবিত ছবিটির প্রত্যেকটি সিকোয়েন্স আলোছায়ার বিন্যাস সহ একটা খাতায় এঁকে রেখেছিলেন। তার আগে উদয়শংকরের ‘কল্পনা' ছবিতে ক্যামেরা এবং আলোছায়ার আশ্চর্য ব্যবহারে মোহিত হয়ে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসে অনেক স্টিল তুলেছিলেন। সে সময় একদিন তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হতেই তিনি সেই ছবি আমাকে দেখালেন। নানা নান্দনিকদিক থেকে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন ছবিগুলোর বৈশিষ্ট্য কি! রবিশংকরের ওপর ছবি করার প্রেরণার পেছনে হয়ত 'কল্পনার কিছু অবদান ছিল। অন্তত সেই সময় আমার তাই ধারণা হয়েছিল।
সেসময় থেকে সত্যজিৎ রায় এমন কোন ছায়াছবি তৈরি করেননি যার জন্যে আঁকাজোকার মারফত তাঁর ছবির সব দিক থেকে তিনি প্রস্তুতি করেননি। প্রতিটি চরিত্রের মেক-আপ, পোষাক-পরিচ্ছদ, সেটের এবং প্রপের খুঁটিনাটি, তাছাড়া শটের ফ্লেমিংতো আছেই। খাতার পর খাতা ভরে গিয়েছে এসব আঁকায়। কয়েকটি মাত্র কলমের খোঁচায় এসব অনবদ্য সব রচনা তাঁর বাসস্থানের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব স্কেচের সঙ্গে আছে তার চমৎকার হাতের লেখায় নানা ‘notes', যা একটি খুঁতখুঁতে মনের পরিচয় দেয়। তিনি যে হাড়ে হাড়ে একজন পারফেকশনিষ্ট এই পাতাগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। এসব আঁকার মধ্যে আছে অনেক চরিত্রের মুখ যেগুলো বেশ যত্ন নিয়ে আঁকা। এগুলোতে শুধু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ফুটে ওঠেনি, আঁকার দিক থেকেও বেশ পাকা হাতের কাজ। ড্রইং এ তাঁর যে বিশেষ দখল আছে তার পরিচয় ত তিনি তাঁর ডি. জে. কীমারের দিনগুলো থেকেই দিয়ে এসেছেন। আবার কিছু ড্রইং দেখেছি যেগুলো কয়েকটি ঝটপট লাইনে আঁকা। তাঁর আকার বৈচিত্র্য শুধু ছায়াছবি সংক্রান্ত আঁকাজোকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর লেখা অসংখ্য কাহিনীর চিত্রায়নের জন্যে আঁকাতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্রেফ হরফ দিয়ে নানা ধরনের যে কি বিচিত্র সব নক্সা তৈরি করা যায় 'এক্ষণ' পত্রিকার মলাটগুলো তার সাক্ষ্যবহন করে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এগুলো দেখে মনে হয় খেলাচ্ছলে করা, কিন্তু তাঁর হরফের উদ্ভাবনী শক্তি প্রতিবারই তাঁকে নতুন নতুন দিগন্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কখনো জ্যামিতিক অ্যাবস্ট্রাকশনে পরিণত, কখনো গীতধর্মী, আবার কখনো বা নিছক ক্যালিগ্রাফিক নক্সা, আবার কখনো বা Collage এর ধাচে করা। 'এক্ষণ’ সিরিজ, আমার মতে তাঁর একটি বিশিষ্ট কীর্তি। এ সূত্রে চিত্রাভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জীর কবিতার বই-এর মলাটটির কথাও মনে পড়ে। খুব উঁচু দরের ক্যালিগ্রাফির একটি বিশিষ্ট উদাহরণ বলা যায়। এই সঙ্গে সত্যজিতের পোস্টার ডিজাইন সম্বন্ধে দুয়েকটি কথা বলি। এগুলো তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে চিরকালই পরিগণিত হবে। ছায়াছবির বিষয়বস্তু এবং মেজাজের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রেখে এগুলো রচিত হয়েছে। তাদের চিত্রগত দিক কিংবা image-এর সঙ্গে মানানসই করে হরফগুলো উদ্ভাবিত হয়েছে। যেমন দেবীর পোস্টারে “দেবী” কথাটি দেবীর মুকুটের মত করে আঁকা হয়েছে। লেখা এবং দেবীর মুখের ছবির এমনই মিলন ঘটেছে যে এর ওপর আর কোন ইম্প্রুভমেন্টের স্কোপ তিনি রাখেন নি। প্রত্যেকটি পোস্টারকে এভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে একথাই মনে আসবে। তাই আলাদা আলাদা ভাবে সেগুলো নিয়ে লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এছাড়াও আছে তাঁর বিভিন্ন ছবির জন্যে তৈরি টাইটেল কার্ডগুলো। সেখানেও টাইপোগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফির অসাধারণ খেলা। প্রতিটি ছবির বেলায় তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা এবং কল্পনাশক্তি লড়িয়ে দিয়েছেন। ছবি শুরু হবার আগে এই কার্ডগুলোর সাহায্যে তিনি ছবির বিষয়বস্তু এবং মেজাজের একটা সূক্ষ্ম আভাস দিয়েছেন জেতা ইতিপূর্বে ভারতীয় সিনেমায় দেখা যায়নি।
কয়েকবছর আগে সত্যজিৎ কুরাসাওয়া-র নিজের ছায়াছবির জন্যে আঁকা একটি রঙিন ছবির বই আমাকে দেখিয়েছিলেন। বইত দেখতে দেখতে একথাটি আমার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিলো যে, সত্যজিৎ রায়ের আঁকা অসংখ্য এবং বিচিত্র কাজের এমন একটি প্রকাশনা কি নিছক একটি স্বপ্নই থেকে যাবে। কথাটি আজও আমার মনে বাসা বেঁধে আছে।
Other articles in this category
- সোভিয়েত চলচ্চিত্র-পঞ্চাশ বছর | Soviet Chalachitra 50 Bochor- প্রবাদ পুরুষ - Prabad Purush
- সত্যজিৎ রায়ের আঁকাজোকা - Satyajit Rayer Anka Joka
- Reading History with Satyajit Ray
- পথের পাঁচালীর পূর্বকথা - Pather Panchalir Purbakotha
- প্রথম সম্বর্ধনা , প্রথম মানপত্র | First Felicitation, First Certificate
- Shining a light on Satyajit Ray
- সত্যজিৎ-চলচ্চিত্রে কালচেতনা | Significance of Time in Ray's Film
- ডক্টর সত্যজিৎ রায় | Doctor Satyajit Ray
- চিন্তা ও সৃষ্টি | Idea and Creativity
- Manikda and the little songs of his cherished road
- Eclipse Series 40: Late Ray
- Feluda is one of Satyajit Ray’s greatest creations but is he too brilliant for the movies
- Returning to Life: The Apu Trilogy in Buffalo
- Revisiting Ray’s Films In The Current Socio-Economic Context Of India
- The Apu Trilogy: Every Common Sight