সোভিয়েত চলচ্চিত্র-পঞ্চাশ বছর | Soviet Chalachitra 50 Bochor
by সত্যজিৎ রায় | Satyajit Ray
সোভিয়েত বিপ্লবের পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষ্যে তৎকালীন *ইসকাস* (Indo-Soviet Cultural Society) একটি উৎসব আয়োজন করে। সেই উৎসব সমিতির পক্ষ থেকে “সোভিয়েত বিপ্লব পরিচয়” নামে এক সংকলন প্রকাশিত হয়, প্রকাশক ছিলেন ‘ধরণী গোস্বামী এবং অমিয় গুপ্তু’ । সেই সংকলনে প্রকাশের জন্য সত্যজিৎ রায় “সোভিয়েত চলচ্চিত্র” প্রবন্ধটি দিয়েছিলেন। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে ইসকাস সংগঠনের বর্তমান রূপ অর্থাৎ ‘ইসকাফ’ যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে (সম্পাদনা বন্দনা ভট্টাচার্য), সেখানে এই প্রবন্ধটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

সোভিয়েত চলচ্চিত্রের ক্রমবিবর্তনের কথা বলতে গেলে প্রথমে প্রাক রুশ চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বলা দরকার।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে প্রায় একই সময়ে চলচ্চিত্রের জন্ম হয়। জনসাধারণের মনে এই চলমান ছবি প্রচন্ড বিস্ময় ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ফলে ব্যবসা হিসাবে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আবিষ্কর্তাদের মনে কোন সংশয়ের অবকাশ ছিল না। তাই দেশ বিদেশে ছায়াচিত্র দেখিয়ে এই স্বর্ণপ্রসূ আবিস্কারের মহিমা প্রচার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

যে বছরে দ্বিতীয় নিকোলাইয়ের অভিষেক হয়, সেই ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের লুমিয়ে কোম্পানি মস্কোতে প্রথম সিনেমাটোগ্রাফ প্রদর্শনের আয়োজন করে। এর কিছুদিনের মধ্যেই ইংল্যান্ডের রবার্ট পলের ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টমাস এডিসনের ছায়াচিত্র রাশিয়ায় দেখানো হয়। এর ফলে রুশ জনসাধারণ ---- এবং সেই সঙ্গে নিকোলাইও ----ছায়াচিত্রের মোহপাশে আবদ্ধ হয়ে পড়েন।
প্রথম ছায়াচিত্রের দর্শকের মধ্যে রাশিয়ার পন্ডিত ব্যাক্তিরাও কেউ কেউ ছিলেন। ভ্লাদিমির স্তাসোফ ছিলেন তখনকার শ্রেষ্ঠ সংগীত সমালোচক। এডিসনের তোলা চলন্ত রেলগাড়ির ছবি তাঁকে অ্যানা কারেনিনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এই আদিম চলচ্চিত্র সম্পর্কে ম্যাক্সিম গোর্কির মতামত বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। গোর্কি বলেন, “আজকের দিনের মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা থেকে বিশেষ উদ্দীপনা লাভ করে না। কিন্তু এই সব সাধারণ ঘটনাই চলচ্চিত্রে এক ঘনীভূত নাটকীয় রূপ ধারণ ক’রে সে একই মানুষের মনকে নাড়া দেয়। ভয় হয় একদিন হয়ত এই চলচ্চিত্রের জগৎ বাস্তব জগৎকে অতিক্রম করে মানুষের হৃদয় মন অধিকার করে বসবে।"

সে যুগে ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যোগসূত্র ছিল ঘনিষ্ঠ। তাই গোমো, পাথ ইত্যাদি ফরাসী ছায়াচিত্র কোম্পানি অল্পদিনের মধ্যেই রাশিয়ার বাজার দখল করে বসল । তখনকার অধিকাংশ ছবিই ছিল বাস্তব ঘটনামূলক, অর্থাৎ এখন যাকে নিউজরীল বলা হয় সেই জাতীয়। ক্রমে উপন্যাস ও নাটকের ওপর ভিত্তি করে ছবি তোলা শুরু হল, এবং সিনেমার জনপ্রিয়তা অনেকগুণে বেড়ে গেল।
১৯০৩ সালে রাশিয়াতে ফরাসী ছবির পরিবেশনের ব্যবসায় যোগ দিলেন প্রথম রুশ পরিবেশক গুট্সমান্। গুট্সমান্-এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে একে একে অনেক রুশ ব্যবসাদার চিত্র পরিবেশনের কাজে নেমে পড়লেন ।
এর পর তিন বছর রুশ-জাপান যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ইত্যাদি সত্ত্বেও চলচ্চিত্র ব্যবসা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। ১৯০৭ সালে আলেকজান্দার দ্রাস্কফ্ প্রথম রুশ প্রযোজক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। তার পরের বছর দ্রাস্কফ্ প্রযোজিত প্রথম রুশ ছবি 'স্টেস্কা রাজিন' প্রকাশিত হল এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করল। দ্রাস্কফ্ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী খানজস্কফ্ বেশ কিছুদিন ধরে রুশ ছায়াচিত্রের বাজারে নেতৃত্ব করেন। দ্রাস্কফ্-এর কীর্তির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তলস্তয় কে ক্যামেরার সামনে উপস্থিত করা। স্থিরচিত্র তোলানোর ব্যাপারে তলস্তয়ের আপত্তি ছিল যথেষ্ট, সুতরাং সিনেমাটোগ্রাফ তোলানোর প্রস্তাবে তিনি যে প্রথমেই নারাজ হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু চলন্ত ছবির নমুনা দেখে তিনি রীতিমত উৎসাহিত বোধ করেন। তাঁর মত ছিল, রুশ চলচ্চিত্রকারের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কাল্পনিক কাহিনী বর্জন করে সাধারণ রুশ কৃষকের বাস্তব জীবন ছায়াচ্চিত্রে বর্নিত করা।
প্রথম মহাযুদ্ধ ব্যবসার দিক দিয়ে রুশ চলচ্চিত্রের ক্ষতিতো করেইনি, বরং ইউরোপীয় ছবির আমদানি বন্ধ করে দিয়ে দেশজ ছবির সম্প্রসারণের পথ সহজ করে দিয়েছিল। উনিশ’শ সাতের প্রথম রুশ ছবি থেকে শুরু করে বিপ্লবের আগে পর্যন্ত দ্রাস্কফ্ ও খানজস্কফ্ ছাড়া যারা রুশ চলচ্চিত্রের ক্রমবিবর্তনে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে যুগ্ম প্রয়োজক থীমানও রাইনহার্ট, পরিচালক গনচারফ, প্রোটাজানফ ও ইয়েভগেনি বাউয়ের, সাহিত্যিক ও নাট্যকার লিওনিদ আন্দ্রেইফ, নাট্য প্রযোজক মায়ারহোল্ড ও বিপ্লবী কবি মায়কফ্স্কির নাম উল্লেখযোগ্য।

রুশ শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে যে কজন চলচ্চিত্রকে শিল্পের মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিলেন এবং সেই বিশ্বাসে চিত্র নির্মানের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, তাঁর মধ্যে আন্দ্রেইয়েফ্এর নাম সর্বাগ্রে করতে হয় । ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিতে আপোলিনেয়র, দান্নুনৎসিও গেহার্ট হাউপ্টমান প্রমুখ অগ্রণী সাহিত্যিকেরা চলচ্চিত্রের কাজে যোগ দিতে দ্বিaypধা করেন নি। আন্দ্রেইয়েফ চেয়েছিলেন, রুশ শিল্পী সাহিত্যিকেরাও উন্নাসিকতা বর্জন করে চলচ্চিত্রের কাজে এগিয়ে আসুক। আন্দ্রেইয়েফের প্ররোচনায় একাধিক সাহিত্যিক চিত্র-নাট্যকার হিসাবে বিভিন্ন প্রযোজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু প্রযোজকদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে এসব চিত্রনাট্যের কোনটাই অবিকৃত ভাবে পর্দায় পৌঁছতে পারেনি।
১৯১৩ সালে মায়াকফস্কির প্রথম চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতারও পরিসমাপ্তি হল শোচনীয় ভাবে। তাঁর স্বরচিত চিত্রনাট্য শুনে প্রযোজক পার্স-কি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। অথচ কিছুদিন পরে এই পার্স-কি প্রযোজিত একটি ছবিতে মায়াকফস্কি তাঁর চিত্রনাট্যের প্রায় অবিকল প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। আধুনিক মঞ্চরীতির অন্যতম পথিকৃত মায়ারহোল্ড ১৯১৪ সালে অস্কার ওয়াইল্ডের পিচার ওফ ডোরিয়ান গ্রে থেকে একটি ছায়াচিত্র রচনা করেন। এ ছায়াছবি রচনা যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মতে নির্বাক চিত্রের ইতিহাসে ডোরিয়ান গ্রে অভিনবত্বে জার্মানির ‘কালিগারি'র সঙ্গে তুলনীয়।
দুঃখের বিষয় রুশ নাট্যজগতের অন্যতম শিরোমনি কন্স্তান্তিন তানিসলাভ্স্কি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটা বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করে গিয়েছিলেন।

জুরিখে নির্বাসনকালে সারাদিনের পর লেনিন প্রায়ই সন্ধ্যাটা কাটাতেন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে। এটা যে কেবল অবসর বিনোদনের জন্য তা নয়। লেনিনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সংবাদ চিত্র দেখে সেই সব দেশের জনসাধারণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আচার ব্যবহার লক্ষ্য করা। ছায়াচিত্র যে মানুষের জ্ঞানের পরিধি আশ্চর্যভাবে প্রসারিত করতে পারে, একথা লেনিন জুরিখে থাকাতেই বুঝেছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে একটা প্রবল দেশাত্মবোধ সমস্ত রাশিয়াতে পরিব্যপ্ত হয়েছিল। এর প্রতিফলন রুশ ছায়াচিত্রেও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। রাশিয়ার জয় হোক, জার্মানি নিপাত যাক- এই ছিল যুদ্ধের প্রথম বছরের রুশ ছবির বিষয়বস্তু। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে যখন দেশে অরাজকতা শুরু হল, জার্মান ও অস্ট্রীয় সৈন্য তাদের লুপ্ত এলাকা পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিল এবং তারও পরে যখন যুদ্ধ সম্পর্কে অনীহা এবং জারীয় শাসন নীতিতে গভীর অনাস্থা জনসাধারণের মনে বদ্ধমূল হতে লাগল, তখন এই ব্যপক ভাঙ্গনের চেহারাটাও যেন চলচ্চিত্রে দেখা গেল । "Not normal men and women, but devils, as cetics, vampires peopled the films of the Russian winter of 1916"(Jay Leyda)!
অথচ ফিল্ম ব্যবসায় মন্দার কোন প্রশ্ন তখনও ওঠেনি। প্রযোজনা ও পরিবেশনের কাজ করছে একশ' চৌষট্টিটি চালু কোম্পানি, চল্লিশ লক্ষ রুবলের ওপর মূলধন খাটছে ফিল্ম ব্যবসায়। আসলে যেটার অভাব ছিল সেটা হল শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চয়তা।

১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে চলচ্চিত্র-কর্মীদের মনে একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল, কিন্তু প্রভিশনাল গভর্ণমেন্ট সে আশাকে সাময়িকভাবে ব্যাহত করল। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রুশ ইতিহাসের গতি ও পরিনতির বিবরণ এখানে অবাস্তব, তবে এটা বলা দরকার যে অক্টোবরের এক মাস আগেই একটি জরুরি শ্রমিক সম্মেলনে, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শিল্পের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিৎ সে সম্বন্ধে কতগুলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। অবশ্যই এ-সম্মেলনের একটা প্রধান আলোচ্চ বিষয় ছিল চলচ্চিত্র। বিপ্লবোত্তর শ্রমিক শিল্প-সঙ্ঘ প্রোলেটকুণ্টের সূত্রপাত এই সম্মেলনেই।
বিপ্লবে বলশেভিক দলের জয় যখন অবধারিত, তখন নিজেদের ভবিষৎ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে বহু ব্যালে ও চলচ্চিত্র শিল্পী রাশিয়ার দক্ষিণে বলশেভিক অধিকৃত এলাকার বাইরে গিয়ে ডেরা বাঁধেন। আরো পরে এইসব জায়গা ছেড়ে তাঁদের পশ্চিমে, অর্থাৎ ইউরোপে এবং আমেরিকায় গিয়ে পড়তে হয়। এঁদের মধ্যে অবিশ্যি সাধারণ কর্মীর চেয়ে প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাই ছিল বেশি। এঁদের অনেকেই আর দেশে ফেরেন নি, অথচ বিদেশে গিয়ে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন এমন দৃষ্টান্ত খুব কম।

সোভিয়েত রাশিয়ায় চলচ্চিত্র ব্যবসার জাতীয়করণের ঘটনাকাল হল ১৯১৯। অক্টোবর ১৯১৭ থেকে আগষ্ট ১৯১৯-এর মধ্যে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এক হল, প্রথম সরকারী সিনেমা কমিটি উদ্ভব। দ্বিতীয়, শিক্ষা অধীনে ক্রুপ্স্কায়ার তত্ত্বাবধানে একটি চলচ্চিত্র উপ-বিভাগ গঠন। সিনেমার দিকে সরকারের এতটা দৃষ্টি চিত্রব্যবসায়ীদের মনঃপুত হল না। ফলে মস্কো থেকে আরো কিছু চিত্র প্রযোজক যন্ত্রপাতি সমেত দক্ষিণে পলায়ন করলেন। স্বভাবতই এর ফলে একটা সঙ্কটাপন্ন অবস্থার উদ্ভব হল। অবশেষে সরকার একটি আইন জারী করে এই পলায়নের পথ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন এবং তারপর আরেকটি নতুন কমিটি তৈরি করে প্রয়োজকদের চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দেবার ব্যবস্থা করলেন। সিনেমা কমিটির প্রথম দিকের ইস্তাহারগুলিতে চলচ্চিত্রের শিল্পের চেয়ে শিক্ষার দিকটাতেই বেশি জোর দেওয়া হত। শিল্পের দিকটা দেখতেন পরিচালক নিজেই।
মায়াকফ্স্কি আগে যে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলন, ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে তিনি সে-সুযোগ পেলেন। পরপর চারখানা চিত্রনাট্য তিনি মস্কোর নেপচুন কোম্পানির জন্য লিখলেন। শুধু তাই নয়- এর একটিতে (জ্যাক লন্ডনের মার্টিন ইডেনের চিত্ররূপ)। তিনি প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ও করলেন। কিন্তু পরিচালনার দুর্বলতা হেতু, মায়াকফ্স্কির মতোই চারখানার একখানা ছবিও উৎরোয় নি।
১৯১৮ সালের পয়লা মে-তে মস্কোর রেড স্কোয়ারে প্রথম মে দিবস উৎসবের ছবি তুলতে সিনেমা কমিটি এক তরুণ আলোকচিত্র শিল্পীকে নিযুক্ত করলেন। এর নাম এডুয়ার্ড টিসে। উত্তর কালে আইজেনস্টাইনের ক্যামেরা-ম্যানরূপে ইনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন।

সেই বছরেই জুন মাসের সাতাশ তারিখে প্রথম সোভিয়েত কাহিনী চিত্র ‘সিগন্যাল' প্রদর্শিত হয়। ছবির পরিচালকের নাম ছিল আলেকজাদার আর্কাতক। এর কিছুদিন পরেই AgitTrain-এর সূচনা। এই অ্যাজিট ট্রেনে ছিল খবরের কাগজ ও হ্যান্ডবিল ছাপার ব্যবস্থা, নতুন নাটক লেখার ও অভিনয় করার দল ও ফিল্ম তৈরী করার জন্য কর্মী ও সরঞ্জাম। ট্রেনের গন্তব্য স্থল ছিল রাশিয়ার পূর্ব সীমান্ত। রেড আর্মি তখন চেক সৈন্যর সঙ্গে যুদ্ধ করে কাজান পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এই রেড আর্মির সৈন্যদের উদ্দীপিত করার জন্যই অ্যাজিট ট্রেনের সৃষ্টি। এই ট্রেনের চলচ্চিত্র কর্মীদের পুরোভাগে ছিলেন এডুয়ার্ড টিসে। যা ছবি তোলা হত, তার সম্পাদনার ভার নিতে এগিয়ে এসেছিলেন বিংশতি বর্ষীয় তরুণ কবি জিগা ভের্টফ্।
সোভিয়েত সরকারের শিক্ষা প্রচারের ব্যাপক উদ্দ্যোগ দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি নিজে থেকে এগিয়ে এসে একটি বক্তৃতা মারফৎ চলচ্চিত্র ও নাটক সম্পর্কে কতগুলি প্রস্তাব করেন। এই দুই শক্তিশালী শিল্প মাধ্যমের সাহায্যে সভ্যতার ইতিহাস কী ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থিত করা যেতে পারে বক্তৃতায় তিনি সেই কথাই বলেছিলেন। দুঃখের বিষয়, যন্ত্রপাতি, লোকবল ও অর্থবলের দিক দিয়ে সোভিয়েত চলচ্চিত্র তখনও এমন অবস্থায় পৌছায় নি যাতে গোর্কির এই মহান পরিকল্পনাকে সুষ্ঠুভাবে রূপদান করা সম্ভব হয়। গোর্কি পরিকল্পিত পঁচিশটি চিত্রনাট্য তাই কাগজের পৃষ্ঠাতেই রয়ে গিয়েছিল।
তিন
সোভিয়েত চলচ্চিত্র জাতীয়করণের কিছুদিন পরেই একটি মার্কিন ছবি রাশিয়াতে মুক্তি লাভ করে এবং সোভিয়েত জনসাধারণ ও চলচ্চিত্র কর্মীদের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে। ছবিটি গ্রিফিথ পরিচালিত ‘ইনটলারেন্স'। পরে গ্রিফিথের অন্যান্য ছবিও রাশিয়াতে ব্যাপকভাবে দেখানো হয়। সোভিয়েত চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর গ্রিফিথের প্রভাব আইজেনস্টাইনও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিলেন।

আইজেনস্টাইন ১৯১৮ সালে পেট্রোগ্রাডে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষা করে রেড আর্মিতে যোগ দেন। সেই সময় অ্যাজিট ট্রেনে ব্যবহারের জন্য কিছু প্রচার চিত্র তিনি এঁকেছিলেন। যুদ্ধের পরে ইনঞ্জিনীয়ারিং স্কুলে ফিরে এসে আবার কিছু দিনের মধ্যেই স্কুল ছেড়ে প্রোলেটকুন্টে যোগ দিয়ে তিনি সোভিয়েত শিল্পের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
ইতিমধ্যে একটি সরকারী চলচ্চিত্র শিক্ষায়তন সূচিত হয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে কিছু প্রাক্ বিপ্লব চলচ্চিত্র কর্মীদের সঙ্গে রয়েছেন অ্যাজিট ট্রেনের অন্যতম ক্যামেরাম্যান লেভ কুলেশফ্।
এই শিক্ষায়তনের প্রথম মে-দিবস উৎসবে আমরা সোভিয়েত চলচ্চিত্রের আরেকজন ভবিষ্যৎ দিক্পালের সাক্ষাৎ পাই। এঁর নাম সেভোলোভ পুদোভকিন। পুদোভকিন ছিলেন রাসায়নিক। থ্রিফিথের ‘ইনটলারেন্স’ দেখে উৎসাহিত হয়ে ইনি চলচ্চিত্রের কাজে এগিয়ে আসেন। এর হাতে-খড়ি হয় অভিনেতা হিসাবে।

একে একে এগিয়ে এসে সিনেমার কাজে যোগ দিয়ে যাঁরা সোভিয়েত চলচ্চিত্র শিল্পকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, উপরোক্ত তিন জন ছাড়া তাঁদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্দার দোভচেস্কো, গ্রিগোরি কোজিন্ৎসেফ, লিওনিদ ত্রাউবের্গ, সের্গেই ইউৎকেভিচ্, মিখায়েল চিয়াউরেলি, ফ্রীভরিশ এরমলের, সের্গেই ভাসিলিয়েফ, মিখাইল কালাটোজোফ্। বিপ্লবের পরের কয়েকটা বছর স্বভাবতই রুশবাসীদের একটা সংকটময় অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে চিত্রনির্মানের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের একান্ত অভাব দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিকার কল্পে লেনিন একটি নতুন অর্থনৈতিক পন্থার NEP প্রবর্তন করলেন যার ফলে বাণিজ্যের পথ কিছুটা সুগম হল। কিন্তু তার পরেই দেখা দিল দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ। চিত্রপ্রযোজকেরা দুর্ভিক্ষের সাহায্যকল্পে দুর্ভিক্ষের ছায়াচিত্র তুলে সারা দেশে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। এই জাতীয় তিনখানা ছবি পরপর তোলা হয়। তার মধ্যে একটির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন পুদোভকিন। আরেকটি ছবি ---The Famine in Russia তুলেছিলেন নরউইজীয় পর্যটক ডাঃ ফ্রিট্জফ ন্যানসেন। এ ছবি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকায় দেখানোর ফলে রাশিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ব্যাপক সহানুভূতি উদ্রেক করতে সমর্থ হয়েছিল।

এর পরে ক্রমে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে স্বশাসিত চলচ্চিত্র বিভাগ স্থাপিত হতে থাকে। জর্জিয়া ও ইউক্রেনের স্টুডিওতে নতুন উদ্যমে ছবি তোলা শুরু হয়, স্টেট ফিল্ম স্কুলে কুলেশভের পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলতে থাকে। পুদোভকিনও এই সময় কুলেশভের সঙ্গে যোগ দেন।
লেনিন বলেছিলেন যে নবগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রে কাল্পনিক কাহিনীমূলক ছবির চেয়ে বাস্তবভিত্তিক ছবির মূল্য অনেক বেশি। সাম্যবাদী আদর্শ ও সোভিয়েত জীবনযাত্রার বাস্তবরূপ প্রচারের জন্য ১৯২২ সালের মে মাসে ‘কিনো প্রাভদা'র সূচনা হয়।' কিনো প্রাভদা' ছিল সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের চলচ্চিত্র সংস্করণ। অ্যাজিট ট্রেনের জিগা ভের্টফের তত্ত্বাবধানে এই সংবাদ চিত্র তোলা হত। কিনো-প্রাভদা কে আজকের দিনের সাপ্তাহিক নিউজরীলের জনক বলা চলে।

যাবতীয় সোভিয়েড ফিল্ম-পত্রিকারও আবির্ভাব হয় এই সময়েই। “কিনো’, ‘ফটো কিগে’ ইতাদি পত্রিকা প্রায় একই সময় আত্মপ্রকাশ করে। 'কিনো গেজেটা' নামক সপ্তাহিক পত্রিকা ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়ে আজও পর্যন্ত টিকে আছে।
আইজেনস্টাইন প্রোলেটকুণ্টের পক্ষ থেকে এই সময় অস্ত্রভস্কির Enough Simplicity In Every Wise Man নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। এই নাটকেরই অংশ হিসাবে Glumov's Film Diary নামে একটি ব্যাঙ্গাত্মক টুকরো কিন্তু আইজেনস্টাইনকে তুলতে হয়েছিল। এটাই ছিল চলচ্চিত্রে আইজেনস্টাইনের হাতে খড়ি।
১৯২৩-এর ১৭ই আগষ্টের একটি ইস্তাহারে সমস্ত বেসরকারী চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান তুলে দিয়ে সোভিয়েত সরকার প্রযোজনা ও পরিবেশনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। এর পরেই নির্বাক সোভিয়েত চলচ্চিত্রের সুবর্ণযুগের শুরু। আশ্চর্য অল্প সময়ের মধ্যে সোভিয়েত ছবির সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যে ক'টি ছবি এই সুনামের জন্য দায়ী তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল কুলেশভের ব্যাঙ্গাত্মক The Extraordinary Adventures of Mr. West in the land of the Bolsheviks, পুদোভকিনের দুখানা ছবি The Death Ray ও Mechanics of the Brain, ভের্টফের বাস্তবভিত্তিক চলচ্চিত্র Kino-Eye আইজেনস্টাইনের Strike।

কুলেশভ Mr. West রচনা করেছিলেন প্রধানত চলচ্চিত্র অভিনয় সম্পর্কে তাঁর কতগুলো মৌলিক থিওরি যাচাই করার জন্য। প্রাক-বিপ্লব রুশ ছবিতে যে অভিনয় রীতি ব্যবহার হত তা ছিল রঙ্গমঞ্চের রীতি। মস্কো আর্ট থিয়েটারের অভিনয় পদ্ধতিকে চলচ্চিত্রেও দুর্লঙ্ঘ্য বলে মেনে নেওয়া হত। কুলেশভের বিশ্বাস ছিল সিনেমার অভিনয় রীতি হওয়া উচিত একেবারে স্বতন্ত্র এবং এই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে অভিনেতাদের দিয়ে নতুন ধরনের অভিনয় করিয়ে Mr. West-এ কুলেশভ ষোল আনা সাফল্য অর্জন করেছিলেন।
পুদোভকিনও তাঁর প্রথম ছবি Death Ray-তে কতকগুলি নতুন জিনিসের প্রবর্তন করেন। চলচ্চিত্রে জনসমাবেশের দৃশ্য সুষ্ঠু ভাবে দেখাতে হলে এই জনতাকে দিয়েও যে সংঘবদ্ধ ভাবে অভিনয় করানো দরকার, এটা পুদোভকিনই প্রথম প্রমাণ করলেন। তাছাড়া শ্রমিক আন্দোলনের দৃশ্যে এই ছবিতে পুদোভকিনই প্রথম অভিনেতাদের শ্রমিক সাজানোর রীতি বর্জন করে আসল শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিলেন।
জিগা ভের্টফ ‘কিনো আই’তে প্রমাণ করলেন যে ক্যামেরা যদি বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে এবং সূনির্বাচিত ডিটেলের সাহায্যে সেই বাস্তবের স্বরূপ উন্মোচন করতে পারে, তবে চলচ্চিত্র লোকচিত্ত জয় করার জন্য সাজানো গল্পের অপেক্ষা রাখে না। প্রসঙ্গত, হালফিলের Cinema Varite রীতির সঙ্গে চল্লিশ বছর আগের কিনো আই রীতির কোন প্রভেদ নেই। এখানে ভের্টফের উক্তি প্রণিধানযোগ্য: "It is necessary to get out of this limited circle of ordinary vision; reality must be recorded not by imitating it, but by broadening the renge ordinarily encompassed by the human eye"।

Strike ছবিতে আইজেনস্টাইন সোভিয়েত চলচ্চিত্রে বিপ্লব আনলেন। তথাকথিত প্লট বা কাহিনীর অনুপস্থিতি, কেন্দ্রস্থ কোন নায়ক চরিত্রের অনুপস্থিতি - এসব ছিল তখনকার যুগে অভাবনীয়। Strike এর বিষয় বস্তু হল একটি প্রাক বিপ্লব ধর্মঘট-কীভাবে সে ধর্মঘটের সূত্রপাত হল, এবং কীভাবে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের উপর বলপ্রয়োগ করে ধর্মঘট ভেঙ্গে দিলেন। এই সরল কাঠামো অবলম্বন করে সুনির্বাচিত টাইপ চরিত্র দৃশ্যপট ও ডিটেলের সাহায্যে এবং সম্পাদনা ও দৃশ্য পরিকল্পনার কৃতিত্বে আইজেনস্টাইন Strike ছবিতে আশ্চর্য নাটকীয় আবেগের সঞ্চার করলেন। আইজেনস্টাইন যে সম্পাদনা রীতির উদ্ভব করেছিলেন তাকে তিনি 'Montage of Attractions' আখ্যা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, তাঁর মতে ছবির প্রতিটি শট্-এ এমন উপাদান থাকবে যা একক ভাবে এবং তার পূর্বের ও পরের শট্-এর সঙ্গে সংযুক্ত ভাবে, দর্শকের মনকে ক্রমাগত আকৃষ্ট, চমকিত ও উদ্বেলিত করবে।
এর পরের বছর ছিল ১৯০৫-এর বিপ্লবের বিংশতিতম স্মৃতি উৎসব পালনের বছর। আইজেনস্টাইন ততদিনে প্রোলেটকুন্ট ছেড়ে চিত্র পরিচালক হিসেবে মস্কোর একটি স্টুডিওতে যোগদান করেছেন। ১৯০৫-এর ঘটনাবলী চিত্রায়িত করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হল। এবং এই ঘটনাবলীকে ভিত্তি করে রচিত একটি চিত্রনাট্যও তাঁকে দেওয়া হল। এই '১৯০৫' চিত্রনাট্যই শেষ পর্যন্ত 'পোটেমকিন'-এর রূপ নিল। এই বিশ্ববিশ্রুত বিশিষ্ট ছবির ব্যাখ্যা এখানে নিস্প্রয়োজন। কিন্তু এ তথ্য প্রকাশ করা দরকার যে সোভিয়েত বিদগ্ধ জনের উচ্ছ্বাস লাভ করলেও, 'পোটেমকিনের’ সরকারী অনুমোদন লাভ করতে আইজেনস্টাইনের বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। ১৯২৬ সালে বার্লিনে দেখানোর ফলে জার্মান দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভের পর ছবিটি রাশিয়ায় প্রথম ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়।

এই একই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সোভিয়েত ছবি হল গোর্কির উপন্যাস অবলম্বনে পুদোভকিনের 'মাদার'। পোটেমকিনের মতই ‘মাদার’ সোভিয়েত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। মাদার ও পোটেমকিনের তুলনামূলক বিচারে এই দুই মহান চিত্রপরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আইজেনস্টাইনের আঙ্গিকে জ্যামিতিক ছকের আভাস সুস্পষ্ট। এর ফলে বিষয় বস্তুর মানবিক দিকটা কিঞ্চিত ব্যাহত হলেও, মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সরল, সবল এবং ঋজুভাবেই উপস্থাপিত হয়। পুদোভকিনের ছবিটির মানবিকতা ও গীতিময়তা লক্ষণীয়। আঙ্গিকের দখলও অবশ্যই আছে। তবে আইজেনস্টাইনের অকাটা গাণিতিক অবশ্যম্ভাবিতা নেই। সংগীতের উপমা দিলে বলতে হয় আইজেনস্টাইন যেন বাখের কথা স্মরণ করায়, আর পুদোভকিন যেন বেটোফেনের সমগোত্রীয়।
সোভিয়েত নির্বাক চলচ্চিত্রের তৃতীয় প্রতিভা আলেকজান্ডার দোভচেঙ্কোর আবির্ভাব হয় ১৯২৬ সালে। দোভচেঙ্কো ছবি আঁকতেন। গণতান্ত্রিক সমাজে চিত্র শিল্পের চেয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ বেশি উজ্জ্বল এই ধারণা অকস্মাৎ তার মনে উদিত হওয়ায় তিনি খারকভের বাড়ি ছেড়ে ওডেসার ফিল্ম স্টুডিওতে উপস্থিত হন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দুখানা কমেডি ছবি করে হাত পাকিয়ে তিনি তাঁর উপকথামূলক তৃতীয় ছবি Zvenigora রচনা করেন। ছবিটি শেষ হওয়ার পর ওরে ওডেসার স্টুডিও মালিক তার মস্কোর প্রতিনিধিকে সেটি পাঠান। উক্ত প্রতিনিধি ছবি দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আইজেনস্টাইন ও পুদোভকিনের মতামতের জন্য তাঁদের ডেকে এনে সেটি দেখানোর ব্যবস্থা করেন। আইজেনস্টাইন বলেছেন, "Pudovkin and I had a wonderful task : to answer the questioning eyes of the uditorium with a joyful welcome of our new colleague and to be the first to greet him"।

এর পরের চার বছরের মধ্যে একের পর এক বহু ছবি সোভিয়েত চলচ্চিত্রের খ্যাতি সারাবিশ্বে পরিব্যাপ্ত করতে সাহায্য করে। আইজেনস্টাইনের 'জেনারেল লাইন' ও 'অক্টোবর', পুদোভকিনের 'এন্ড অফ সেন্ট পিটার্সবার্গ' ও 'স্টর্ম ওভার এশিয়া', দোভচেঙ্কোর 'আর্সেনাল' ও 'আর্থ', টুরিনের ডকুমেন্টারি 'টুর্কসিব', রুমের 'বেড এন্ড সোফা',এর্মলেরের 'ফ্রাগমেন্টস অফ অন এম্পায়ার', মিখাইল রমের,'দ্য গোস্ট দ্যাট ইউল নট রিটার্ন' ইত্যাদি সবই এই চার বছরের মধ্যে তৈরি।
“জেনারাল লাইন” ছবি সম্পাদনার সময়ই আইজেনস্টাইন স্টেট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করবার কথা চিন্তা করেছিলেন। চলচ্চিত্র তত্ত্ব নিয়ে গভীর চিন্তার ফলে তিনি যে সমস্ত মৌলিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, সেগুলি তরুণ ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
স্টেট ইনস্টিটিউটে বছরখানেক অধ্যাপনা পর আইজেনস্টাইন ক্যামেরাম্যান টিসে ও সহকারি আলেকজান্দ্রফকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা যাত্রা করেন। ১৯২৯ সালে আমেরিকায় সবাক চিত্রের প্রবর্তন হয়। এই নতুন আবিষ্কার সম্বন্ধে তথ্য আহরণ ছিল এই সফরের একটি প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়া আইজেনস্টাইন কিছুদিন যাবত মার্কস-র 'ক্যাপিটাল'-এর একটা চিত্ররূপ পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং তার বিশ্বাস ছিল গণতান্ত্রিক আমেরিকার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না হলে একাজ সম্ভব নয়।

আমেরিকায় পৌছানোর পর হলিউডের দু’একটি কোম্পানি আইজেনস্টাইন কে ছবি করার প্রস্তাব দেন। এগুলি শেষ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যায়। অবশেষে আপ্টন সিনক্লেয়ারের পৃষ্ঠপোষকতায় মেক্সিকান সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রামাণ্য ছবি Que Viva México তোলার উদ্দেশ্যে মেক্সিকোয় গিয়ে দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে, লক্ষ লক্ষ ফুট ফিল্ম বার করে, তার সমস্তই সিনক্লেয়ারের জিম্মায় রেখে দেশে ফিরে আসেন। সিনক্লেয়ার কথা দিয়েছিলেন ল্যাবরেটরির কাজ শেষ হলে সমস্ত মাল সম্পাদনার জন্য রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সিনক্লেয়ার একটি চিঠিতে জানান যে মেক্সিকোর খরচ উসুল করার জন্য তিনি সমস্ত মাল আর একটি হলিউড কোম্পানি্কে বেচে দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে রাশিয়ায় সবাক ছবি তোলা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে এবং প্রথম সবাক ছবি নিকোলাই এক্-র কাব্যময় 'রোড টু লাইফ' দেখানো হয়ে গিয়েছে। শব্দ ও ইমেজর কী সম্পর্ক হওয়া উচিৎ তাই নিয়ে তর্ক-বিতর্কও সিনেমা পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। একে একে পুদোভকিন(ডেজার্টার), দোভোচেঙ্কো(ইভান), ইউৎকেভিচ(গোল্ডেন মাউনটেনস), কুলেশভ(মেন অ্যান্ড জব্স) - সকলেই সবাক ছবি তুললেন। অন্যান্য দেশের চেয়ে কিছু দেরীতে আরম্ভ করার ফলে প্রথম দিকের সোভিয়েত সবাক চিত্রে ইউরোপ বা আমেরিকার প্রথম সবাক ছবির দোষগুলি (কথার অতিরিক্ত প্রাধান্য বা সরাসরি মঞ্চাভিনয়ের চিত্ররূপ ছিল না)।

নির্বাক যুগে চারখানা ছবি তৈরি করা সত্ত্বেও আমেরিকা থেকে ফিরে এসে আইজেনস্টাইন সরকারের কাছ থেকে তেমন সমাদর পেলেন না। চারিদিকেই তখন শিল্পীদের উপর সরকারী নজরের মাত্রাটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আইজেনস্টাইন তাঁর পরবর্তী ছবির জন্য যে কাহিনী নির্বাচন করেছিলেন, কর্তা শুমিয়াৎস্কি তা নাকচ করে দিয়ে অন্য আর একটি বিষয় নিয়ে ছবি করার আদেশ দিলেন। সেটিও শেষকালে বানচাল হয়ে যাওয়ায় আইজেনস্টাইন চিত্র রচনার কাজ বন্ধ করে দিয়ে অধ্যাপনার কাজে মনোনিবেশ করলেন। একাকে অবশ্য তাঁর উৎসাহের অভাব ছিল না। অল্পকালের মধ্যেই নানান শিক্ষারীতির প্রবর্তন করে তিনি বিদ্যালয়ের ভোল একবারে পাল্টে দিলেন।
।। চার ।।
সবাক যুগের আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত সোভিয়েত চলচ্চিত্রের এই পঁয়ত্রিশ বছরের অনেকটা সময় অনেক প্রথম শ্রেণীর সোভিয়েত পরিচালক সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে হয় ইচ্ছামত ছবি করতে পারেন নি, না হয় ছবি করে তা সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক সময় সরকার তৈরি ছবির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তার প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার এক এক সময় ছবি প্রদর্শিত হয়ে সরকারী সমালোচনার করাঘাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। এমন নাহলে, যে দেশে গড়পড়তা বছরে একশটি ছবি তৈরি হয়েছে, যে দেশের নির্বাক ছবি সারা বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অর্জন করেছে, সে দেশে সবাক যুগে ত্রিশ বছরের প্রায় তিন হাজার ছবির মধ্যে মাত্র ত্রিশখানা ছবির নাম কেন লোকে মনে রাখবে?

এর একটা কারণ অবশ্য এই যে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারটার মধ্যে কতকগুলো পরস্পর বিরোধী দিক আছে যেগুলো সমাজব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। যেমন - দর্শকনিরপেক্ষ ভাবে চলচ্চিত্র রচনা সম্ভব নয় - সে যেমন আমেরিকাতেও নয়, তেমনই সোভিয়েত রাশিয়াতেও নয়। অথচ দর্শকমন বলে যে বস্তুটির উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, বা থাকা সম্ভব নয়। তাহলে সেই দর্শকমনের সঙ্গে শিল্পীমনের সমন্বয় ঘটবে কী করে? দ্বিতীয়, ধনতান্ত্রিক সমাজে চিত্রনির্মাতার স্বাধীনতা যেমন মালিক পক্ষের খেয়ালখুশির উপর নির্ভরশীল, সেরকম গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার যেখানে শিল্পের সংজ্ঞা নির্দেশ করে দেবেন, সেখানেও শিল্পীর স্বাধীনতা এই নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে আবদ্ধ। আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন, দোভচেঙ্কো, দন্স্কই প্রমুখ প্রত্যেককেই কোন না কোন সময় তাঁদের রচিত চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্রের জন্য সরকারী কটাক্ষ ভোগ করতে হয়েছে। অথচ এঁরা যে প্রতিভাবান সমাজসচেতন শিল্পী নন একথা বলার স্পর্ধা আমাদের আছে কি?
ত্রিশ শতকের কিছু সবাক সোভিয়েত ছবি স্বকীয় ঔজ্জ্বল্যে আজও দেদীপ্যমান। আইজেনস্টাইনের ‘আলেকজান্দার নেভস্কি, ভ্যাসিলিয়েফ ভ্রাতৃষয়ের ‘চাপাইয়েফ'। ভের্টফের 'থ্রি সংস অফ লেনিন', দন্স্কই-এর গোর্কির জীবনী, দোভচেঙ্কোর 'শরস'এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে প্রথম মহাযুদ্ধের মতই একটা ব্যাপক দেশাত্মবোধের উন্মেষ সরকার ও শিল্পীর মনোভাবের একটা সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ফলে কিছু স্মরণযোগ্য ফ্যাসিস্ট বিরোধী ছবি ও কিছু চমৎকার ডকুমেন্টরির উৎপত্তি হয়। যুদ্ধকালীন আরো কয়েকটি ভালো ছবির মধ্যে পুদোভকিনের ‘জেনারেল সুভোরোফ' ও দোভচেঙ্কো-কৃত উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিচুরিনের জীবনী চিত্রের নাম করা যেতে পারে। কিন্তু চিত্রনির্মাতার স্বাধীনতার অভাবে কোনটাই মহৎ শিল্পের পর্যায় পৌঁছিতে পারেনি।

আইজেনস্টাইনের শেষ ছবি ‘ইভান দি টেরিবল'ও রচিত হয় এই যুদ্ধের মধ্যেই। তিন খণ্ডে পরিকল্পিত এই বিশাল ঐতিহাসিক চিত্রের প্রথম খণ্ডটি ১৯৪৪ সালে প্রদর্শিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডটির প্রকাশ স্তালিনের আমলে নিষিদ্ধ ছিল। কারণ, সরকারী মতে পরিচালক নাকি ইভান চরিত্রে অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা আরোপ করে ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন এবং প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে স্তালিনোত্তর যুগে ইভানের দ্বিতীয় পর্ব দেখে আমরা উপলব্ধি করি যে চলচ্চিত্রে যদি কোন শিল্পরীতি শেক্সপিয়রের পংক্তিতে স্থান পাবার যোগ্যতা রাখে তবে তা আইজেনস্টাইন রচিত দুইখণ্ডে অসমাপ্ত ইভানের জীবনীচিত্র। ঐ ছবি আদৌ চলচ্চিত্র কিনা, নাকি একে অপেরার ছাঁচে ঢেলে পরিচালক চলচ্চিত্র শিল্পের অবমাননা করেছেন বা ইতিহাসকে বিকৃত করার অধিকার চলচ্চিত্র রচয়িতার আছে কি না ইত্যাদি অনেক অর্বাচীন তর্ক ইভানকে কেন্দ্র করে হয়েছে এবং এখনও হয়ে থাকে। সুখের বিষয় মহৎ শিল্পকীর্তির স্থান চিরকালই সমালোচনার অনেক উর্ধ্বে।
স্তালিনোত্তোর যুগে সোভিয়েত সরকারের চলচ্চিত্র নীতি অনেকটা মোলায়েম হলেও, সাম্প্রতিক সোভিয়েত চলচ্চিত্র কিছুটা নিষ্প্রভ বলে মনে হয়। বিশেষত আধুনিক জীবনযাত্রামূলক ছবিতে পারস্পরিক সম্পর্কে প্রায়ই একটা অতিরিক্ত সরলীকরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে মাঝে মাঝে এখনও প্রথম শ্রেণীর কাজ দেখা যায় ঐতিহাসিক বা জীবনীমূলক ছবিতে। আর দেখা যায় শেক্সপীয়র, শেকফ, তলস্তয় গোত্রীয় সৎসাহিতিক্যের নাটক বা উপন্যাসের ভিত্তিতে রচিত ‘পিরিয়ড' ছবিতে। এই সব দিক দিয়ে সোভিয়েত ছবি নিঃসন্দেহে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কারণ অভিনয়রীতির বৈচিত্র্যে, আলোকচিত্র গ্রহণের লালিত্যে, সাজসজ্জা ও দৃশ্যপটের বাস্তবানুগত্যে, রং ও সংগীতের পরিমিত ও রুচিপূর্ণ ব্যবহারে সোভিয়েত ছবির সত্যিই তুলনা নেই এবং একথা আগের মতই এখনও প্রযোজ্য।

তাই যেমন ভোলা যায় না 'আর্থ' ছবিতে চাঁদনিরাতে খোলা মাঠে ভ্যাসিলির নাচের দৃশ্য, বা পোর্টেমকিনে ওডেসার সিঁড়িতে হত্যাকাণ্ডের শব্দহীন বিভীষিকা, তেমনই ভোলা যায় না চেরকাসভের ইভান, স্মোকটুনফস্কির হ্যামলেট, বোন্দরচুকের ওখেলো; ভোলা যায় না নেভস্কি ও ইভানে প্রোকোফিয়েফের সঙ্গীত, ভোলা যায় না মিচুরিনে দোভচেস্কোর রং এর ব্যবহার, হ্যামলেট এলসিনোরের কেল্লা, ওয়ার অ্যান্ড পীসে নাটাসার নাচের দৃশ্য।









Other articles in this category
- সোভিয়েত চলচ্চিত্র-পঞ্চাশ বছর | Soviet Chalachitra 50 Bochor- প্রবাদ পুরুষ - Prabad Purush
- সত্যজিৎ রায়ের আঁকাজোকা - Satyajit Rayer Anka Joka
- Reading History with Satyajit Ray
- পথের পাঁচালীর পূর্বকথা - Pather Panchalir Purbakotha
- প্রথম সম্বর্ধনা , প্রথম মানপত্র | First Felicitation, First Certificate
- Shining a light on Satyajit Ray
- সত্যজিৎ-চলচ্চিত্রে কালচেতনা | Significance of Time in Ray's Film
- ডক্টর সত্যজিৎ রায় | Doctor Satyajit Ray
- চিন্তা ও সৃষ্টি | Idea and Creativity
- Manikda and the little songs of his cherished road
- Eclipse Series 40: Late Ray
- Feluda is one of Satyajit Ray’s greatest creations but is he too brilliant for the movies
- Returning to Life: The Apu Trilogy in Buffalo
- Revisiting Ray’s Films In The Current Socio-Economic Context Of India
- The Apu Trilogy: Every Common Sight